গত ১৫ ও ১৭ এপ্রিল পবিত্র আল আকসা মসজিদে রোজা পালনরত ফিলিস্তিনি মুসলমানদের উপর যায়নবাদী ইসরাইলী সেনাদের নৃশংস হামলা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। ওই হামলার সময় ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে বহু ফিলিস্তিনি মুসল্লি আহত হন এবং চার শতাধিক রোজাদার ফিলিস্তিনিকে ইহুদিবাদী সেনারা ধরে নিয়ে যায়।
এছাড়া ১৫ এপ্রিলের হামলার সময় ইসরাইলি সেনারা পবিত্র আল আকসা মসজিদের ভিতর ঢুকে ফিলিস্তিনি মুসল্লিদেরকে লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়ে এবং মুসলমানদের প্রথম কেবলা এই পবিত্র মসজিদটির অবমাননা করে। এই নির্মম ও ন্যক্কারজনক ঘটনা বিশ্বের তাবত মুসলমানের মনকে আহত করেছে। বাংলাদেশ ও ইরানসহ বিশ্বের অনেক দেশ এই ঘটনায় যায়নবাদী ইসরাইলের নিন্দা করে এর প্রতিকারের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দাবি জানিয়েছে।
এই রমজান মাসে ইসরাইলের বর্ণবাদী সরকার যখনফিলিস্তিনে এই নৃশংসতা চালালো তখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। সম্ভবত এই দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করে সম্প্রতি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর নির্বাহী কমিটির এক জরুরি সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি ইসরাইলের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলমান নতুন কোনো সংকট ও সংঘাতের কারণে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ ফিলিস্তিনের এই দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা সঠিক হবে না।
দুই দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হচ্ছে ফিলিস্তিনের জনগণ নিদারুন কষ্ট ও বেদনাদায়ক জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছেন। তারা নিজ দেশেই পরাধীন, উদ্বাস্তু। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। এর উপর ক্ষণে ক্ষণে প্রায়ই বর্ণবাদী সেনাদের নিষ্ঠুরতম হামলা ফিলিস্তিনিদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো।
১৯৪৮ সালে বৃটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিদের ভূমি জবরদখলের মাধ্যমে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের পর থেকেই বর্ণবাদী ইহুদিদের হাতে তাদের মার খাওয়ার ইতিহাস শুরু, যা চলছে অদ্যবধি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ঝরছে রক্ত। আকাশ ছুঁয়েছে লাশের পাহাড়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা দমেনি। মাতৃভূমি এবং ধর্মীয় পবিত্র স্থান দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে তারা নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে দশকের পর দশক ধরে।
ফিলিস্তিন অঞ্চল ছিল তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। আরব মুসলমানেরা ছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উনিশ শতকের শেষ দিকে বিশ্বে উগ্র ইহুদীগোষ্ঠি কর্তৃক যায়নবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইহুদিদের চোখ পড়ে আরব ভূখণ্ডের দিকে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর ইশারায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে বাসা বাঁধতে থাকে। আরব ভূখণ্ড দখল করে ‘আবাসভূমি’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে তারা সেখানে নিজেদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়াতে থাকে।
বিশ শতকের শুরুর দিকে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ইউরোপীয় শক্তিগুলো ফিলিস্তিনে তাদের প্রভাব বাড়ায়। ধুর্ত ব্রিটিশরা তখন একদিকে ক্ষমতায় বসানোর প্রলোভন দেখিয়ে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরব দলপতিদেরকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামাতে সক্ষম হয়। অপর দিকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদেরও গোপনে আশ্বাস দেয়।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসস্থান’ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে সরাসরি সমর্থন জানায়। অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ হাতে পায় ব্রিটিশরা। তখন বৃটিশদের সহায়তা এবং আশ্বাসে ফিলিস্তিনে দলে দলে অভিবাসী ইহুদি আসতে থাকে। স্থানীয় আরবদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেখানে বহিরাগত ইহুদিরা ক্রমেই বসতি গড়ে তোলে। এরপর ১৯২০,২১,২৮,২৯ ও ৩৬ সালে আরবদের সঙ্গে ইহুদিদের সংঘর্ষ হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর ইহুদিরা সেখানে নিপীড়নের নিশানায় পরিণত হয়। ফলে জার্মানি থেকে দলে দলে ইহুদিরা পালিয়ে ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের হামবড়া ভাব তখন আরও বেড়ে যায়। ব্রিটিশ শাসন ও ইহুদি দখলদারির বিরুদ্ধে ১৯৩৬-১৯৩৯ সালে ফুঁসে ওঠে স্থানীয় আরবরা। সূচনা হয় বিদ্রোহের। ব্রিটিশরা ওই বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করে। নিহত হয় পাঁচ হাজারের বেশি আরব মুসলমান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন নিয়ে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে বৈরিতা বেড়ে যায়। ওই সময় ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। একই সঙ্গে এই ভূখণ্ডের ভাগ্য নির্ধারণে সদ্যগঠিত জাতিসংঘকে অনুরোধ জানানো হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনিকে দ্বিখণ্ডিত করে পৃথক ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দেয়। আরবদের বিরোধিতা সত্ত্বেও পরিকল্পনাটি এগিয়ে যায়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নীলনকশায় ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়।